রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে টি টুয়েন্টি 2020!

রাত পোহালেই শুরু হচ্ছে টি টুয়েন্টি 2020!

সূর্যাস্তের সাথে সাথে বিদায় নিয়েছে ২০১৯ সাল। আরো ও একটি নতুন সূর্য বছরকে আগমন জানাতে সমগ্র পৃথিবী বাসী উন্মুখ হয়ে আছে।

পৃথিবী গ্রহের হিসাব অনুযায়ী আমাদের কাছে নতুন বছর মানে ২০২০ সাল। একটি আগমনী বছর। এই নতুন বছরকে সবাই ২০২০ নামে ডাকবে।

সময়কে হিসাবের ফ্রেমে আবদ্ধ করার জন্য মানুষ কতই–না একক ঠিক করেছে। কয়েকটির নাম বলি। এই যেমন ট্রপিক্যাল ইয়ার (এক বছর সময়), ফিসক্যাল ইয়ার (তিন মাস সময়), লাসট্রাম (পাঁচ বছর সময়), ইন্ডিকশন (১৫ বছর সময়) ইত্যাদি।

হোক, এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। ২০২০–বিষয়ক প্রসঙ্গ। বয়সের হিসাব ও অন্য জাগতিক কাজকর্মের হিসাব রাখার জন্য আমাকেও ট্রপিক্যাল ইয়ারের নিয়ম অনুযায়ী চলতে হয়। কিন্তু সত্যিটা হচ্ছে আমার কাছে একেকটি বছরকে একেকটি গল্পের মতো মনে হয়।

কেউ যদি প্রতিদিন এক পাতা করে দিনের ঘটে যাওয়া বিষয়গুলো লিখে রাখতেন, তাহলে প্রতিবছর ৩৬৫ পাতার একেকটি গল্পের বই হয়ে যেত। আর গল্পগুলো ইতিহাস হয়ে থাকত। সূর্যের চারপাশ দিয়ে একবার ঘুরে আসতে আসতে একেকটি নতুন ইতিহাসের জন্ম হওয়াই–বা কম কিসের। মানুষ প্রতিদিন যেটুকুই অর্জন করুক না কেন, প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির ঊর্ধ্বে দিনের শেষে শুধু গল্পটাই অবশিষ্ট থাকে।

বাস্তবিক পক্ষে প্রকৃত সময়ের ব্যাপ্তিকে শুধু আমার আগে উল্লেখকৃত সময় একক দিয়ে পরিমাপ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে কখনো কখনো। যদি কোনো দিন কারও হাজার বছর পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে, বেছে বেছে আকাশের সবচেয়ে অপূর্ব ও উজ্জ্বল তারার দিকে তাকালেই হবে। একেকটি তারাকে মনভরে দেখা মানে শুধু কয়েক হাজার বছর নয়, বরং কয়েক কোটি আলোকবর্ষ অতীতে ফিরে দেখা।

একেকটি উজ্জ্বল, কখনোবা চলমান তারা, তাদের কোটি কোটি বছরের জমানো গল্পের ইতিহাস নিয়ে আলোর বেগে আমাদের দিকে ধাবিত হয়ে আসছে। অধিকাংশ তারারই হয়তো বিরতিহীন গন্তব্যের কোনো একপর্যায়ে মৃত্যু ঘটে। আমাদের কারও চোখে আলো পৌঁছানোর আগেই ওরা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে এবং শূন্যে ধুলো হয়ে মিলিয়ে যায়। যেমনটি মিলিয়ে যাই আমরা একদিন।

গল্প ও স্বপ্নগুলো অসম্পূর্ণ থাকা কোনো ব্যর্থতা নয়। বরং এগুলোর কোনোটা শুরু না করাই ব্যর্থতা। নিঃশেষ হয়ে যাওয়া অথবা বিফলে যাওয়া কোনো পরাজয় নয়, বরং সত্য ও প্রকৃতির নিয়মের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা।

এই লেখা যখন প্রকাশিত হবে, তখন নতুন আরেকটি বছরের সূচনা। পাল্লা দিয়ে সবাই হিসাব–নিকাশ শুরু করবে কী অর্জন হলো অথবা কোনটা খোয়া গেল সেটার। কেউ হয়তো আগামী বছরগুলোকে আরও অর্থবহ করে তুলতে নতুন সংগ্রামের নকশা আঁকবে। আমার কাছে জীবন অর্থবহ হওয়ার সংজ্ঞাটা একটু ভিন্ন। আমি মনে করি, সবার হাততালি পাওয়ার যোগ্য হওয়া মানেই সার্থকতা নয়, বরং এ পর্যন্ত নিজেকে কতটুকু চেনা হলো অথবা আবিষ্কার করতে পারলাম, সেটাই মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। নিজের পদমর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ও অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর বিপক্ষে আমি নই। আমার বক্তব্য শুধু এটাই যে আমরা সচরাচর জীবনকে শুধু অর্জন ও ব্যর্থতার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলেও বাস্তবে জীবনের পরিধি আরও বেশি বিস্তৃত। আর যদি কোনো অর্জনের প্রত্যাশা থেকেই থাকে, তাহলে সেটার জন্য শুধু আগ্রহ প্রকাশ করাই পর্যাপ্ত নয়, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে হবে।

যে মুহূর্তগুলো এখনো আসেনি, সেটাকে অনর্থক ভয় পাওয়া বোকামি। কারণ ভবিষ্যৎকে বোঝার চেষ্টা করার চেয়ে অতীতকে বুঝলে ভবিষ্যতের পথচলাটা আরও সহজ হয়। পৃথিবীর অন্য সবকিছুর মতো স্মৃতিও বিলীন হয়। এমনকি সবচেয়ে আনন্দদায়ক অথবা কষ্টেরটিও। তাই স্মৃতি মুখস্থ রাখার চেষ্টা না করে শুধু সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়াটাই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। এই বর্তমান মুহূর্তটিই সব। এটাকেই আমরা জীবন নামে ডাকি। যেটা এখনো আসেনি, সেটার নাম জীবন নয়। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবাটা যৌক্তিক। কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অথবা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থাকা সময়ের অপব্যবহার। মানুষের ভবিষ্যতের কোনো সীমানা নেই। সেটা কত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, সেটা অনির্ধারিত ও অসংজ্ঞায়িত। আমরা মানুষেরা ও এই সভ্যতার প্রতিটি উপাদান, এমনকি চিন্তা ও বিশ্বাস—এ সবকিছুই একটি চলমান মহাকালের যাত্রী।

তাই আমার বিশ্বাস, যেহেতু সবকিছুই পরিবর্তনের স্রোতে ভাসে এবং ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণ আপাতত আমাদের সক্ষমতার বাইরে, সেহেতু শুধু বর্তমান মুহূর্তগুলোকে ফলপ্রসূ করার মাধ্যমে ভবিষ্যতের অর্জনকে সমৃদ্ধ করতে পারি। প্রতিটি ক্ষণই যদি হয় স্বতঃস্ফূর্ত, গোছানো, আদর্শবান, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল, তাহলে শুধু আগামী বছর নয়, আগামী জীবন ও প্রজন্মও হবে সমৃদ্ধশীল ও সম্ভাবনাময়। একমাত্র এই উপায়েই আমরা মহাকালের এই বিরতিহীন যাত্রায় নিজেদের অবস্থানকে মর্যাদাশীল ও সুদৃঢ় করার অবকাশ খুঁজে পেতে পারি।

আমরা আমাদের ছোট ছোট অর্জন উৎসবময় করতে পারি, কৃতজ্ঞতাবোধে ভরিয়ে দিতে পারি। যেটা আমি পাইনি, সেটা পাওয়ার জন্য আমার জন্ম হয়নি। আমার সেটা অর্জনের কথা ছিল না। আর যেটা পেয়েছি, আমার যা কীর্তি, সেটার জন্য আমি উৎফুল্ল ও অনুপ্রাণিত। অনেকের যা আছে, সেটা আমারও থাকতে হবে, এটি একটি স্ববিরোধী ও অবান্তর উক্তি! কারণ, কেউ হয়তো পৃথিবীতে আর মাত্র পাঁচ মিনিট বেঁচে থাকার সুযোগ পেতে পারে। তার মানে কি এই যে তার ভাগ্য অনুসরণ করে আমাকেও পাঁচ মিনিট পর জগৎ ত্যাগ করতে হবে?

মানুষের জীবনে সীমাবদ্ধতা যেমন আছে, সম্ভাবনাও তেমনই আছে। প্রথমটিকে অতিক্রম করতে হবে এবং পরেরটিকে ছুতে হবে। শুধু মেধাবী হওয়ার অদম্য চেষ্টা না করে কৌতূহলী হতে হবে। মুখস্থ করার ক্ষমতা থাকলেই জ্ঞানী ও মহান হওয়া যায় না। আত্মস্থ করার প্রবণতা বৃদ্ধি ও কল্পনাশক্তির প্রসার ঘটাতে হয়। শুধু তর্ক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সেরা না হয়ে মহানুভবতা ও পরোপকারিতায় সেরা হতে হবে। ক্লান্ত না হয়ে বিস্মিত হতে হবে। বার্ধক্যকে এড়িয়ে চলার কোনো উপায় নেই, বৃদ্ধ হওয়া মানে সম্পূর্ণ হওয়া। এই স্বাভাবিক সত্যকে অনুধাবন করার জন্য যাজক অথবা মহাপুরুষ হতে হয় না।

অনেক মানুষই উচ্চাভিলাষী। তাদের অভিপ্রায় শুধু মানুষে মানুষে অসামঞ্জস্য ও অমিল তৈরি করা। কিন্তু তারপরও আমাদের এই মানুষ প্রাণীদের মধ্যে এক জায়গায় ভীষণ মিল রয়েছে। সেটা হলো আমরা সবাই কিছুর সন্ধান করি কিছু একটাকে চিরস্থায়ীভাবে পেতে। আর সেটা হলো আমরা সবাই সুখী হতে চাই। সেটাও সম্ভব যদি আমরা সমস্ত পৃথিবীকে একটি পরিবার ও নিজেদের সেই পরিবারের সদস্য মনে করি। আমাদের লক্ষ্য যদি হয় পরিবারের সবার নিরাপত্তা ও সুখের অবকাঠামো নির্মাণ করা এবং এই বিশ্বাস যদি আমরা একেবারে মর্মে মর্মে রোপণ করি, তাহলে আমাদের কাছে এই সংক্ষিপ্ত জীবনও অনেক উৎসবমুখর হয়ে উঠবে। মূলত, আমরা সবাই একই প্রাণের উৎস। একই সূর্যের আলোয় একে অপরকে দেখি। একই আকাশের নিচে সবার সকালের ঘুম ভাঙে। একই মাটির ফলানো ফসলে আমাদের ক্ষুধা মেটাই এবং একই মৌলিক উপাদান সবার দেহে বিদ্যমান। সবার প্রাণের গভীরে একই চাহিদা, একই অভিপ্রায়।

২০২০-এ আছে দুটি দুই, দুটি শূন্য ও দুটি বিশ। সংখ্যাগুলোর সমন্বয় এত কাকতালীয়ভাবে মিলে গেল যে আমার মনে হচ্ছে, ২০২০ সালটা সব পরিশ্রমী ও আশাবাদী মানুষের জীবনে বয়ে আনবে অভূতপূর্ব সাফল্য ও সমৃদ্ধি।

শুভ হোক ২০২০।

You may also like...